বাংলাদেশে ছদ্মাবরণ সংস্কৃতি
প্রতিটি জাতির একটি ট্রেডিশন, ঐতিহ্য বা পরমপরা থাকে।

প্রথম নিউজ, ঢাকা: প্রতিটি জাতির একটি ট্রেডিশন, ঐতিহ্য বা পরমপরা থাকে। মন, মেজাজ, অনুভুতি, একজনের প্রতি অন্য জনের মমত্ববোধ বা কর্তব্যবোধ, নিষ্টা, জাতির প্রতি দায়িত্ববোধ, মিথ্যার সাথে আপোষ কামিতা বা মিথ্যার মূখামূখি দাড়িয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা প্রভৃতি সহ আনুসাঙ্গিক নিজস্ব নিয়মানুবর্তিতা থেকেই শুরু হয় একটি জাতির সংস্কৃতির গোড়াপত্তন। এ গোড়াপত্তন ধীরে ধীরে আত্নপ্রকাশ করে গ্লোবাল বিশ্ব পরিক্রমায় দৌড় প্রতিযোগীতা রয়েছে। এ প্রতিযোগীতা কোথাও কোথাও থমকে গেছে বা কোথাও কোথাও গতি পেয়ে অনেক উচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও ক্ষয়ূষ্নু রোগে ধ্বংস হয়েছে। এক সময়ে বলাহতো যে, ব্রিটিশ রাজ্যে সূর্য অন্ত যায় না। এখন ব্রিটিশ বাধ্য হয়ে গণরোষে নিজেকে অনেকখানি খাপিয়েছে বটে, কিন্তু তাদের ট্রাডিশন পৃথিবীব্যাপী প্রতিষ্ঠা করেছে। ব্রিটিশ একটি দখলকার জাতি, কিন্তু নিজেদের একটি সভ্য জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছে যাদেরকে পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রেই অনুকরণ করে, বিশেষ করে ব্রিটিশের লিগ্যাল সিষ্টেম পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত।
বহুজাতির সংমিশ্রনে বাঙ্গালী একটি জাতিতে পরিনত হয়েছে। সংবিধানের ৬(২) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙ্গালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।” ভূতত্ববিদদের মতে বঙ্গোপোসাগর থেকে সৃষ্টি হওয়া একটি ব-দ্বীপের ভূ-খন্ডের মধ্যেই বর্তমান বাংলাদেশ। ভূতত্ব বিদগণ আরো আশংখা করছেন যে, জলবায়ু জটিলতার কারণে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে সাগারে বিলীন হয়ে যেতে পারে, যদিও এতে ভিন্নমত রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায় নতুন করে এতোবড় চড় জাগছে যা একটি বাংলাদেশের তুলনায় কম হবে না। যদি তাই হয় তবে বাংলাদেশের খাদ্য অভাবতো থাকবেই না, বরং পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্র হিসাবে পরিনত হবার একটি উজ্জল সম্ভবনা আশা করা যেতে পারে। বাংলাদেশকে ভবিষ্যত একটি সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র হিসাবে চিন্তা করার পাশাপাশি এ জাতিকে গুনগতভাবে উচ্চ শিখরে পৌছার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার বিষয়ে প্রজন্মকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। বাঙ্গালী জাতির যেমন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে মায়ের ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়, অন্যদিকে জাতির সাথে বেঈমানীর ইতিহাসও কম নহে। এই জাতির ইতিহাসে সিরাজদৌল্ল্যার জন্ম হয়েছে, মীর জাফরের দৃষ্টান্তও অনেক রয়েছে। বর্তমানে সত্যের সাথে যুদ্ধ করে মিথ্যা জয়লাভ করছে এবং এটাই এখন বাঙ্গালী জাতির সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি।
বিভিন্ন সংগঠনের স্বরনীকা প্রকাশ করার জন্য বিশেষ জনের “বানী” আনতে গেলে, সকলেই বলেছেন “বানীটি লিখে নিয়ে এসো”। আজানগাছী দরবার শরীফের স্বরনীকা প্রকাশ করার জন্য একবার আমার উপর দায়িত্ব পরে। এতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের বানী ছাপা হয়েছে যা উদ্দ্যোক্তাদের লিখে দিতে হয়েছে, দায়িত্বশীল স্বনামধন্য ব্যক্তিরা শুধু মাত্র স্বাক্ষর করেছেন। আমি বিআরটিসি’র চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় ২০০৪ সনে ৪৫ বৎসর উৎযাপন উপলক্ষে প্রকাশিত স্বরনীকায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সচিবদের বানী ছিল, যার সবগুলিই বিআরটিসি থেকে লিখে দিতে হয়েছে। ফলে স্বনামধন্য ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কি চিন্তাভাবনা করেন এবং জাতির প্রতি তাদের দিক নির্দেশনা সম্পর্কে জনগণ ও উদ্দ্যোক্তা সংগঠন কিছুই জানতে পারে নাই। স্বমরনীকা’তে বানী প্রকাশে বিআরটিসি বা স্বনামধন্য ব্যক্তিরা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন বলে আমি মন্তব্য করবো না। তবে একটুক বলতে চাই একটা মিথ্যার বহি:প্রকাশ, নাকি দায়িত্ব যথাযথ পালনে অনীহা, আমার বোধগম্য নহে। প্রবাদ রয়েছে যে, মানুষ হাসতে হাসতে পাপ করে। এখন দেখছি যে, মিথ্যা বলতে বা মিথ্যাকে সত্যে পরিনত করার প্রক্রিয়া দিনে দিনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
সত্যের উপর অধিষ্ঠিত থেকে নিষ্টার সাথে নিজ দায়িত্ব পালন করার শপথ নিয়ে সাংবিধানিক পদ যারা দখল করে আছেন তারাও শুধুমাত্র নিজ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে জনগণকে ধোকা দিচ্ছেন, বিনিময়ে শাসকগোষ্টির আজ্ঞাবহ হয়ে ভবিষ্যত বংশধরসহ সূখে শান্তিতে জীবন কাটানোর নিশ্চিয়তা আদায় করে নিচ্ছেন এবং একটাই জাতির অন্যতম একটি ট্রাজেডি। দায়িত্বশীল বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসে মিথ্যা বলা বা মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার যে প্রবনতা বা সংস্কৃতি শুরু হয়েছে তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছে না। কারণ দেশপ্রেমের পরিবর্তে চলছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিজেদের অধিষ্ঠিত রাখার প্রবনতা। একটি মিথ্যাকে প্রমাণ করার জন্য ১০টি মিথ্যা কথা বলা হয়, তারপরও মানুষ মিথ্যা বলে, অহরহ বলে এবং যেখানে মিথ্যা বলার প্রয়োজন নাই সেখানেও বলে। ফলে কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা বা কোনটা অর্ধ মিথ্যা তাহাও নির্ণয় বা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রায় ২০ বৎসর পূর্বে একটি আলোচনায় শুনেছিলাম যে, জাপানে গনিকাবৃত্তিতে নিয়োজিত পতিতারা তাদের সাথে চুক্তিভিত্তিক মজুরী গ্রহণ করে, কিন্তু বক্শিস নেয় না। অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রকান্তরে ঘুষ ছাড়া একটি টেবিলের ফাইল অন্য টেবিলে যায় না। ইনকাম ট্যাক্স অফিসের লোকেরা এর নাম দিয়েছে “টেবিল মানি”। “টেবিল মানি” এখন রেওয়াজে পরিনত হয়েছে, ব্যতিক্রম কিছু থাকলেও চোখে পড়ার মত নহে। যারা টেবিল মানি ছাড়া কাজ করেনা তাদের মধ্যে অনেকেই বছর বছর হজ্ব করছে অথচ ঘুষ নিতে বিবেক এতোটুকু ধ্বংসন করে না।
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহপাক বলেছেন যে, “সূর্য ও চন্দ্র নির্ধারিত কক্ষপথে ভ্রাম্যমান। তারকা ও গাছপালা তাকেই (আল্লাহকে) সেজদারত” অর্থাৎ আল্লাহর দেয়া নিয়মেই সমর্পিত অর্থাৎ আল্লাহ প্রদত্ব দায়িত্ব পালন করে (সূত্র: সূরা আর রহমান আয়াত ৫/৬)। মানুষকেও সৃষ্টি করা হয়েছে দায়িত্ব পালনের জন্য এবং সৃষ্টির সময় এ দায়িত্ব পালনের জন্য মানুষ সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দায়িত্ব ও কর্তব্যের পাশাপাশি বিবেকই জীবন ধারনের একমাত্র চালিকা শক্তি। বাংলাদেশে খাদ্যে যে পরিমাণ ভেজাল দেয়া হয়, সে পরিমাণ ভেজাল দেয়ার প্রবনতা পৃথিবীর অন্যকোন রাষ্ট্রে নাই। আমাদের দেশে মানুষের জটিল রোগ হওয়ার অন্যতম কারণ ভেজাল খাদ্য ও নিম্নমানের মাদকাশক্ততা।
আদালতে স্বাক্ষ্য দেয়ার পূর্বে মিথ্যা স্বাক্ষ্য দিবে না বলে শপথ গ্রহণ করার পরও মানুষজন মিথ্যা অহরহ মিথ্যা স্বাক্ষ্য দিচ্ছে। মিথ্যা স্বাক্ষ্য দেয়া নৈতিকতা বিরোধী বা জনগণের নিকট হেয় হতে হয় একথা যেন মানুষ ভুলে গেছে। সরকারী আমলারা জনগণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে মিথ্যা কথা বলে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেকেই রয়েছে যারা জনগণকে ধোকা দিতে আস্থাহীনতায় পড়েছে। জনগণের আস্থা বনাম ক্ষমতার দাপট এখন সমান্তরাল গতিতে চলছে না, বরং বিপরীত মুখী অবস্থানে রয়েছে।
বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যা মামলায় ২০ জন ছাত্রের ফাঁসি ও ৫ জনের যাবৎজীবন সাজা হয়েছে। যাদের সাজা হয়েছে তারাও মেধাবী ছাত্র। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একজন ছাত্রকে বুয়েটে ভর্তি হতে হয়। একজন অভিবাবক তার সন্তানকে বুয়েট পর্যন্ত পৌঁছাইতে জীবনের সর্বস্ব ব্যায় করতে হয়। আবরার হত্যায় শাস্তি হয়েছে সন্তোষ্ঠি হয়েছি, কিন্তু আনন্দিত হই নাই, এ কারণে যে, দেশের ২৫টি পরিবার থেকে ২৫ জন সম্ভবনাময় প্রকৌশলী ঝড়ে গেল। রাজনীতিতে লেজুরবৃত্তি প্রকট আকার ধারন করার ছাত্র শিক্ষকগণ এখন লেখাপড়া বা গবেষনায় আত্ননিয়োগ নকরার পরিবর্তে নেতা/নেত্রীদের খুশী রাখার কাজে বেশী আত্ননিয়োগ করে বিধায় শিক্ষাঙ্গনে খুন খারাপীর গোড়াপত্তন হয়েছে।
সৃষ্টিকর্তা ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্য শুধু তাগিদ নয় বরং নির্দেশনা দিয়েছেন। মানুষ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে এটাও নৈতিকতা। কিন্তু প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা করার সময়ই চিন্তা করে কি ভাবে ওয়াদা ভঙ্গ করা যায়। কাগজে কলমে লিখিত দলিল করার পরও দলিলকে অস্বীকার করে। অন্যদিকে আলোচনায় শর্ত প্রদান করা হয় নাই, কিন্তু কথার মার প্যাচ দিয়ে দলিলের ভিন্নতর ব্যাখ্যা প্রদান করে জটিলতার সৃষ্টি করে। মিথ্যা যে নৈতিকতা পরিপন্থী একটি বিষয় তা কেহ উপলব্দি করে না, বরং এটাকে কৌশল মনে করে নিজেকে বুদ্দিমান বা ইনটেলেকচুয়াল মনে করে।
শুধুমাত্র দালান কোঠা বা অবকাঠামোর উন্নয়নই জাতির উন্নয়ন নহে। অবকাঠামোর উন্নয়ন একটি গোষ্টি যারা ক্ষমতার ছত্র ছায়ায় থাকে তারাই ভোগ করে। কিন্তু আমজনতা ভোগ করতে পারে না। কিন্তু সার্বিক ভাবে নৈতিকতার প্রশ্নে একটি জাতির যদি গুনগত উন্নয়ন হয় তবে দুবেলা খেয়ে পড়ে একটি জাতি সম্মানজনক সহ-অবস্থানে সম-অধিকারে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নিরাপত্তার চাদরে বেষ্টিত বসবাসযোগ্য একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারে।
লেখক
অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার
রাজনীতিক, কলামিষ্ট ও আইনজীবি (এ্যাপিলেট ডিভিশন)
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: