নিয়ন্ত্রণহীন তেলের দাম, ঝরছে নিম্নবিত্তের ঘাম
বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত নেই তদারকি।

প্রথম নিউজ, ঢাকা: ভোজ্যতেলে অসহায় ভোক্তারা। আর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি সরকার। বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত নেই তদারকি। এমনকি তেলের বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই সরকারের কাছে। ফলে যখন-তখন তেলের দাম বাড়িয়ে দেন আমদানিকারকরা।
একদিকে সব ধনের জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি অন্যদিকে তেলের দাম লাগাম ছাড়তে থাকায় হাঁসফাঁস অবস্থা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের। ভোক্তা অধিকার কর্মীরা বলছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের দৃঢ় কোনো পদক্ষেপ নেই। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রী বলার পরের দিনই উল্টো হয়ে যায় বাজার। ভোজ্যতেলের এধরনের দাম বৃদ্ধিতে সিন্ডিকেট কাজ করছে। আর সেই সিন্ডিকেটের কাছে সরকার ও জনগণ জিম্মি বলে মন্তব্য করেন তারা।
গত ১৯ জানুয়ারি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছিলেন যে, আগামী ৬ ফেব্রুয়ারির আগে ভোজ্যতেলের দাম বাড়বে না। কিন্তু মন্ত্রীর সেই কথা বাস্তবে রূপ নেয়নি। পরদিন থেকেই বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়তে শুরু করে। বাণিজ্যমন্ত্রীর অনুরোধ উপেক্ষা করে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ২৫-২৬ জানুয়ারি থেকে ভোজ্যতেল সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম ফের বাড়িয়েছেন। সরকার সিদ্ধান্তের আগেই এভাবে তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, বোতলের সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৫ থেকে ৮ টাকা বেড়েছে। খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ১০ টাকা পর্যন্ত। পাম অয়েলের দামও কেজিতে ১০ টাকার মতো বেড়েছে।
ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, নতুন আসা বোতলের এক লিটার তেলের গায়ের (লেভেলে লেখা) মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬৫ থেকে ১৬৮ টাকা, যা আগে ছিল ১৬০ টাকা। আর পাঁচ লিটার বোতলের সয়াবিন তেলের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৮৫ থেকে ৮০০ টাকা, যা আগে ছিল ৭৬০ টাকা। এভাবে সরকার নির্ধারিত দাম উপক্ষো করে আসন্ন রমজানের আগেই তেলের দাম আরো এক দফা বাড়ার আশঙ্কা ব্যবাসীয়দের। যদিও সরকার নির্ধারিত দরে দেশে ভোজ্যতেল তেমন বেচাকেনা হয় না। তারপরও গত বছরের ১৯ অক্টোবর দেশে সর্বশেষ সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে সাত টাকা করে বাড়ায় সরকার। এতে কয়েক দফা বেড়ে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হয় ১৬০ টাকা দরে।
এছাড়া পাঁচ লিটারের এক বোতল তেল বিক্রি হয় ৭৬০ টাকায়। এছাড়া খোলা সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি ১৩৬ টাকা ও বোতলজাত পাম সুপার তেল ১১৮ টাকা দরে বিক্রি হয়। এর আগে গত বছর ৫ সেপ্টেম্বর লিটারে চার টাকা বাড়িয়ে ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তখন দেশের বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল সর্বোচ্চ ১২৯ টাকা এবং এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৫৩ টাকা এবং প্রতি পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৭২৮ টাকা দর নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আর প্রতি লিটার পাম সুপার ওয়েল খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১১৬ টাকা দর নির্ধারণ করা হয়।
গত এক বছরে চারবার বৃদ্ধির পর আবারো বাড়তে শুরু করেছে ভোজ্যতেলের দাম। বরাবরই সরকারের নির্দেশনাকে তোয়াক্কা না করে নিজেদের মতো করে দাম নির্ধারণ করেন আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। ভোক্তাদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনের নেতারা বলছেন, ব্যবসায়ীদের ওপর থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়া ও ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফা প্রবণতার কারণে সরকার নির্ধারিত মূল্য কার্যকর করা যাচ্ছে না। সরবরাহে তেমন ঘাটতি না থাকলেও শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং রেট বেড়ে যাওয়ায় ২০২০ সালের জুন থেকে গত বছর (২০২১) অক্টোবর পর্যন্ত কয়েক ধাপে প্রতি লিটার পাম অয়েলে ৭৪ টাকা, সুপার সয়াবিনে ৬৮ টাকা এবং সয়াবিনে ৬১ টাকা দাম বেড়েছে। শ্রমিক সংকটের কারণে রপ্তানিকারক দেশগুলোতে উৎপাদন কম হওয়ায় বুকিং রেট লাগামহীন বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
২০২০ সালের পহেলা এপ্রিল করোনা সংক্রমণের শুরুতে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি মণ সয়াবিন ৩ হাজার ৩০০ টাকা, পাম অয়েল ২ হাজার ৪০০ টাকা এবং সুপার সয়াবিন ২ হাজার ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হলেও দেড় বছরে ভোজ্যতেলের দাম হয়েছে দ্বিগুণ। প্রকারভেদে প্রতি কেজি ভোজ্যতেলে ৬০ থেকে ৭৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অথচ বাজারে ভোজ্যতেলের তেমন কোনো ঘাটতি ছিল না। এর মধ্যে চলতি বছরের শুরুতেই আবার দাম বাড়ায় ব্যবসায়ীরা। মন্ত্রীর নির্দেশনা না মেনে দাম বাড়ানোয় ব্যবসায়ীদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমে গেছে কি-না এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সহ সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলছি, বাংলাদেশের ভোক্তারা অসহায়। মন্ত্রী বলার পরের দিন উল্টো হয়ে যায়। তার কোনো প্রতিকারও পাওয়া যায় না। আমাদের কাছে অনেক সময় মনে হয় যে, মন্ত্রণালয় চালায় কারা? ব্যবসায়ী না-কি সরকারি লোকজন? এখানেই সন্দেহের তৈরি হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে ভোজ্যতেলের দাম মোট চার বার বাড়ানো হয়েছে। এরপর ২০২১ সালের মে মাসে প্রতি লিটার ভোজ্যতেলের দাম ৯ টাকা বাড়ানো হয়। বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৪৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৫৩ টাকা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সহ সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, আমরা মিটিংয়ে গিয়ে দাম বৃদ্ধির বিষয় বলি, মিডিয়াতে লেখালেখি হয়। কিন্তু সরকার তো কোনোভাবেই আমলে নিচ্ছে না। বাজারে দাম বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরা হলে সরকারের পক্ষ থেকে এটা স্বীকারও করা হয় না। ইনভেস্টিগেট করা হয় না। এটা নিয়ে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইআইটি) এ.এইচ.এম. সফিকুজ্জামান বলেন, আমরা তেলের দাম বাড়াইনি। ব্যবাসায়ীরা কেন বাড়িয়েছেন তা, তাদের প্রশ্ন করুন।
ব্যবসায়ীরা সরকারের নির্দেশনা অমান্য করে দাম বাড়ানোর ব্যাপারে এ.এইচ.এম. সফিকুজ্জামান বলেন, তারা (ব্যবসায়ীরা) জানুয়ারি মাসের ২ তারিখে দাম বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। পরে আমি নিজে মিটিং করে তাদের বলেছি, মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিবেন। তিনি অসুস্থ ছিলেন। পরে ১৯ তারিখে মিটিংয়ে বসার আগেই তারা ১৭ তারিখে তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে, যে জিনিসটা আমরা জানতাম না।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: