নানা অনিয়ম-দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় চলছে চতুর্থ প্রজন্মের নয় ব্যাংক

২০১৩ সালে নয়টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক

নানা অনিয়ম-দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় চলছে চতুর্থ প্রজন্মের নয় ব্যাংক
নয় ব্যাংকের লগো

প্রথম নিউজ, ঢাকা: উধাও হয়ে যাচ্ছে টাকা। কেউ বেনামে দিচ্ছে ঋণ। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কেউ আবার আগ্রাসী বিনিয়োগে ঝুঁকছে। অনেকে আমানতের অর্থ ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে। কেউ পর্ষদের প্রভাব খাটিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে শত শত কোটি টাকা। এভাবে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় চলছে চতুর্থ প্রজন্মের নয় ব্যাংক। 

বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১৩ সালে নয়টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব ব্যাংকের মধ্যে দেশীয় উদ্যোক্তাদের মালিকানায় ছয়টি এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের মালিকানায় অনুমোদন পায় তিনটি ব্যাংক। দেশীয় উদ্যোক্তাদের পরিচালনায় অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলো হলো- মধুমতি, মিডল্যান্ড, ইউনিয়ন, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স, মেঘনা ও পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক)। প্রবাসীদের মালিকানায় অনুমোদন পায় এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড। 

পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-দুর্নীতি আর বিভিন্ন ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছে চতুর্থ প্রজন্মের নয় ব্যাংক। নানা অব্যবস্থাপনায় নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে নিজেদের ইচ্ছামতো চালানো হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ঋণের নামে চলছে লুটপাট। দিনদিন বাড়ছে খেলাপির বোঝা
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসা শুরুর আট বছর পার হলেও বিশেষ কোনো নতুনত্ব আনতে পারেনি চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলো। গতানুগতিক ধারায় কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা। পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-দুর্নীতি আর বিভিন্ন ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছে ব্যাংকগুলো। নানা অব্যবস্থাপনায় নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে নিজেদের ইচ্ছামতো চালানো হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ঋণের নামে চলছে লুটপাট। দিনদিন বাড়ছে খেলাপির বোঝা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা ব্যাংকপাড়ায় বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। 

গত ২০ সেপ্টেম্বর ইসলামি ধারায় পরিচালিত বেসরকারি খাতের [ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ১৯ কোটি টাকা ‘উধাও’ হওয়ার বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। ব্যাংকটির ওই শাখায় পরিদর্শনে গিয়ে ভল্টে রক্ষিত টাকার হিসাবে গরমিল দেখতে পান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কাগজপত্রে দেখানো হয় ভল্টে ৩১ কোটি টাকা রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা সেখানে পান ১২ কোটি টাকা।  বাকি ১৯ কোটি টাকার ঘাটতি সম্পর্কে শাখাটির কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তারা পরিদর্শক দলকে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এত বড় অনিয়মের ঘটনার পরও এ বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। 

শুধু ভল্ট থেকে টাকা সরানো নয়, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকগুলোর বিশেষ ২০০ কোটি টাকার তহবিলের নীতিমালাও লঙ্ঘন করেছে ইউনিয়ন ব্যাংক। এ কারণে গত বৃহস্পতিবার ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক
এ বিষয়ে ইউনিয়ন ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হাসান ইকবাল জানান, গত ১৯ সেপ্টেম্বর ব্যাংকিং লেনদেন শেষে সন্ধ্যার পর শাখায় একজন গুরুত্বপূর্ণ গ্রাহক (ভিআইপি) নগদ টাকা নেওয়ার জন্য আসেন। গ্রাহকের গুরুত্ব ও ব্যাংক-গ্রাহকের সম্পর্ক বিবেচনায় তার কাছ থেকে চেক জমা রেখে নগদ টাকা দেওয়া হয়। পরের দিন বাংলাদেশ ব্যাংক অডিট টিমের উপস্থিতিতে গ্রাহকের চেক ডেবিট করে উক্ত টাকা সমন্বয় করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যাংকের অর্থ হারানোর মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তারপরও বিষয়টি যথাযথভাবে তদন্তের জন্য ইতোমধ্যে ক‌য়েক‌টি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিষয়টির সঠিক তদন্তের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিশ্চিতে ২০১৩ সালে ইউনিয়ন ব্যাংক যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ইসলামি মূল্যবোধ সেভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। শুধু ভল্ট থেকে টাকা সরানো নয়, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকগুলোর বিশেষ ২০০ কোটি টাকার তহবিলের নীতিমালাও লঙ্ঘন করেছে ব্যাংকটি। এ কারণে গত বৃহস্পতিবার ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

এসবিএসি ব্যাংক: গ্রামীণ অর্থনীতি অর্থাৎ উৎপাদনশীল কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা থাকলেও নতুনত্ব কিছু দেখাতে পারেনি সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংক। গতানুগতিক নিয়মেই চলছে তারা। 

কার্যক্রম শুরুর পর নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংক। ‘বিপুল পরিমাণ অর্থ’ আত্মসাতের অভিযোগ মাথায় নিয়েই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ থেকে সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেন। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 

এসবিএসির সাবেক চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন নামে-বেনামে পরিবার ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে নিজ ব্যাংক থেকেই প্রায় ২৬০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন। নামে-বেনামে নেওয়া এসব অর্থ এখন ফেরত পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি
অভিযোগ রয়েছে, এসবিএসির সাবেক চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন নামে-বেনামে পরিবার ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে নিজ ব্যাংক থেকেই প্রায় ২৬০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন। ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নামে-বেনামে নেওয়া এসব অর্থ এখন ফেরত পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। 

ব্যাংকিং-সংক্রান্ত যাবতীয় আইন ও রীতিনীতি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে এসব ঋণ নিয়েছেন তিনি। পরিশোধের সময় পার হলেও খেলাপি হিসেবে এখনও দেখানো হয়নি ওই ঋণ। এছাড়া ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান বস্ত্র খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান থার্মেক্স গ্রুপের আবদুল কাদির মোল্লার বিরুদ্ধেও রয়েছে ঋণ অনিয়মের নানা অভিযোগ। 

রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে মিডল্যান্ড ব্যাংক কিছুটা ভালো অবস্থানে আছে। এখন পর্যন্ত ব্যাংকটির বিরুদ্ধে বড় কোনো অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। চলতি বছরের জুন শেষে এসবিএসির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩৩৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। গত বছরের জুনে যা ছিল ৩০৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা। গত ডিসেম্বরে ব্যাংকটির মন্দ ঋণের পরিমাণ ছিল আরও বেশি। ওই সময় খেলাপির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩৪৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। 

মিডল্যান্ড ব্যাংক: রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে মিডল্যান্ড ব্যাংক কিছুটা ভালো অবস্থানে আছে। এখন পর্যন্ত ব্যাংকটির বিরুদ্ধে বড় কোনো অনিয়মের অভিযোগ শোনা যায়নি। চলতি বছরের জুন শেষে মিডল্যান্ড ব্যাংক চার হাজার ১৮৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি ২৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। যা মোট বিতরণ ঋণের ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। তবে গত বছরের জুনে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ৭০ কোটির ওপরে চলে যায়। ঋণ আদায় ও বিশেষ সুবিধার খেলাপি ঋণ কমিয়েছে ব্যাংকটি।  

মধুমতি ব্যাংক : কার্যক্রম শুরুর পর থেকে বিশেষ কোনো অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি মধুমতি ব্যাংকের বিরুদ্ধে। তবে চলতি বছরের শুরুতে ব্যাংকটির ভোলার চরফ্যাশন শাখার নয় কোটি টাকার অনিয়ম  নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। অনিয়মের তীর যার দিকে সেই শাখার সাবেক ম্যানেজার মো. রেজাউল করিমের সহজ স্বীকারোক্তি, ‘এসব অনিয়ম তিনি বাধ্য হয়েই করেছেন।’ 

সাবেক ওই ম্যানেজার ব্যাংকের গোপন তথ্য তুলে ধরে চলতি বছরের জানুয়ারিতে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের ভাই জাহিদুল ইসলাম সৌরভ, তার ভাতিজা মধুমতি ব্যাংকের চরফ্যাশন শাখা অফিসার তরিকুল ইসলাম নিয়ন্ত্রণ করতেন সবকিছু। ব্যাংকের ক্যাশ থেকে কোটি কোটি টাকা তারা নিয়ে যেতেন। কোথায় নিতেন বা কী করতেন, তা জানাতেন না। 

চলতি বছরের শুরুতে মধুমতি ব্যাংকের ভোলার চরফ্যাশন শাখার নয় কোটি টাকার অনিয়ম নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। অনিয়মের তীর যার দিকে সেই শাখার সাবেক ম্যানেজার মো. রেজাউল করিমের সহজ স্বীকারোক্তি, এসব অনিয়ম তিনি বাধ্য হয়েই করেছেন। তার ওপর আনীত ১২টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে আট কোটি ৯৫ লাখ টাকা গরমিলের প্রসঙ্গে তিনি ওই সময় বলেন, ছয় কোটি ১০ লাখ টাকা ভোলা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের ভাই জাহিদুল ইসলাম সৌরভ তার বিকাশ ব্যবসার জন্য নিয়ে আটকে ফেলেন। ম্যানেজার টাকা চাইলে মাত্র ৪৫ লাখ টাকার চেক দেন। পরে সেই চেকটিও ডিজঅনার হয়। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ব্যাপক হারে বাড়ছে। চলতি বছরের জুন শেষে মধুমতি ব্যাংক তিন হাজার ৮৬৮ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে মন্দ ঋণ দাঁড়িয়েছে ১০৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। যা মোট বিতরণ ঋণের ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ছয় মাস আগেও ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ৪৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৬০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। 

মেঘনা ব্যাংক : শুরুতে বিলাসবহুল ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় করে মেঘনা ব্যাংক। কার্যক্রম চালুর দেড় বছরের মধ্যে প্রধান কার্যালয় স্থানান্তর করা হয়। এতে ভাড়া ও অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার নামে অপ্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় হয়। এসব ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক করে ব্যাংকটিকে। চলতি বছরের জুন প্রান্তিকে মেঘনা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ২২৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। গত ডিসেম্বরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ ছিল ২৪৩ কোটি টাকা। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ গত কয়েক মাস ধরে হু হু করে বাড়তে থাকে। তবে বিশেষ সুবিধা আর ঋণ আদায় করে তারা খেলাপি ঋণ কমিয়েছে। চলতি বছরের জুন প্রান্তিকে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ২২৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। গত ডিসেম্বরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ ছিল ২৪৩ কোটি টাকা। 

পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক): রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম ফারমার্স ব্যাংক। পরে এর নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এহসান খসরু গত ৮ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে সরকারি যেকোনো ব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা ব্যাংককে একীভূত করার প্রস্তাব দেন। নতুন ব্যাংকগুলোর আর্থিক নানা অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টেকে বলেন, কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যাংকের প্রয়োজন, এটা বুঝতে হবে। যাদের অনুমোদন দেওয়া হবে তাদের তো নতুন নতুন আইডিয়া থাকতে হবে। ব্যবসায়িক ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো, সক্ষমতা ও ম্যানেজমেন্টের দক্ষতা আছে— এমন সব লোককে ব্যাংক করার অনুমোদন দেওয়া যেত। কিন্তু আমরা কী দেখেছি, নতুন ব্যাংক দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয় দেখা হয়নি। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় ও ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। 

এখন সরকার নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব ব্যাংকের বিষয়ে তাদের শক্ত হাতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাশাপাশি যেসব ব্যাংক বেশি খারাপ করছে, প্রয়োজন হলে তাদের কিছু ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত (মার্জ) করে দিতে হবে। এছাড়া শুরু থেকেই যারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছে, আস্তে আস্তে তা কমিয়ে দিতে হবে
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন,  ‘যেহেতু চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অনুমোদন নিয়েছে, তাই এসব ব্যাংকের কর্তারা স্বাভাবিকভাবেই মনে করছেন যে তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। তাদের স্বচ্ছতার বিষয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। অনিয়ম করলেও তাদের কেউ ধরবে না। তাই তারা তাদের ইচ্ছামতো চলছে। কোনো নতুনত্ব নেই, পুরনো সেই নিয়মনীতিতে চলছে তারা। এভাবে চলতে দিলে ব্যাংকগুলো কোনো উন্নতি করতে পারবে না— জানিয়ে সাবেক এ গভর্নর বলেন, এখন সরকার নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব ব্যাংকের বিষয়ে তাদের শক্ত হাতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাশাপাশি যেসব ব্যাংক বেশি খারাপ করছে, প্রয়োজন হলে তাদের কিছু ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত (মার্জ) করে দিতে হবে। এছাড়া শুরু থেকেই যারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছে, আস্তে আস্তে তা কমিয়ে দিতে হবে। 

নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে বর্তমানে অনিবাসী বাংলাদেশিদের উদ্যোগে চতুর্থ প্রজন্মের তিনটি ব্যাংক ব্যবসা করছে। এসব ব্যাংক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কার্যক্রমের পরিধি বাড়াতে থাকলেও দেশের অন্য সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ করছে তারা। অথচ তাদের করণীয় ছিল প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করা। 

এনআরবি ব্যাংক : বৈদেশিক বাণিজ্য ও প্রবাসীদের অর্থ সংগ্রহে ভূমিকা রাখার শর্তে লাইসেন্স পায় এনআরবি ব্যাংক। কিন্তু রেমিট্যান্স আহরণে ব্যাংকটির নেই তেমন কোনো ভূমিকা। গেল সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাংকটির মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র এক লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার। খেলাপি ঋণও বাড়ছে প্রতিষ্ঠানটির।  ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এনআরবিসি ব্যাংকের পর্ষদ শুরু থেকে অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। বেনামি শেয়ারহোল্ডার, বহিরাগতদের পর্ষদ সভায় উপস্থিতি, পরিচালকদের স্বাক্ষর জালিয়াতি, তথ্য গোপন করে পরিচালকদের আত্মীয়-স্বজনের নামে ঋণ প্রদান— এমন অসংখ্য অভিযোগ ওঠে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে
চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকটি তিন হাজার ৯৭৫ কোটি ৬১ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। মোট ঋণের ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ অর্থাৎ ২৮৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। এক বছর আগে ব্যাংকটির খেলাপি ছিল ১৪৯ কোটি টাকা যা মোট ঋণের ৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ।  এদিকে, ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মনীতি না মেনে বিভিন্ন সময় আগ্রাসী বিনিয়োগ করছে। সম্প্রতি নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করায় ব্যাংকটিকে ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। 

গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল) : ২০১৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কার্যক্রম শুরু করে চতুর্থ প্রজন্মের বেসরকারি এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক। শুরু থেকে পণ্যের কোনো নতুনত্ব আনতে পারেনি ব্যাংকটি। চলতি বছরের শুরুতে পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক লিমিটেড।  নাম পরিবর্তনের ছয় মাসে ব্যাপক হারে বেড়েছে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত  প্রতিষ্ঠানটি ঋণ বিতরণ করেছে নয় হাজার ৮২০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি দাঁড়িয়েছে ২১৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ২ দশমিক ৭১ শতাংশ। ছয় মাস আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এনআরবি গ্লোবালের মন্দ ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৫ কোটি টাকা।  ব্যাংকটির বিরুদ্ধে আইন ও নিয়মনীতি না মানারও অভিযোগ আছে। সম্প্রতি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকগুলোর ২০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিলের নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সতর্ক করেছে।

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক : কার্যক্রম চালুর পরই বড় ধাক্কা খায় চতুর্থ প্রজন্মের অন্যতম ব্যাংক এনআরবি কমার্শিয়াল। পর্ষদ সদস্যদের অনিয়মে ব্যাংকটিতে নাজুক অবস্থা তৈরি হয়। তবে অতীতের ভুল সংশোধন ও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কাজ করছে বর্তমান পর্ষদ। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এনআরবিসি ব্যাংকের পর্ষদ শুরু থেকে অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। বেনামি শেয়ারহোল্ডার, বহিরাগতদের পর্ষদ সভায় উপস্থিতি, পরিচালকদের স্বাক্ষর জালিয়াতি, তথ্য গোপন করে পরিচালকদের আত্মীয়-স্বজনের নামে ঋণ প্রদান— এমন অসংখ্য অভিযোগ ওঠে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে। এছাড়া বিধিবহির্ভূত সুদ মওকুফ, বেনামে পরিচালকদের ঋণ, পরিচালকদের মধ্যে দ্বন্দ্বসহ নানা অসঙ্গতির তথ্যও উঠে আসে।  অনিয়মের অভিযোগে ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেওয়ান মুজিবর রহমানকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির মূল উদ্যোক্তা যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী ফরাছত আলীসহ বেশ কয়েকজন পরিচালকও পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। 

আমাদের স্বপ্ন সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। যেসব মানুষ ব্যাংকিং সেবা থেকে বঞ্চিত, যারা নিজেদের কর্মের জন্য কারও সহযোগিতা পাচ্ছেন না, তাদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় এনে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। সেই লক্ষ্যে উপশাখা ব্যাংকিং ধারণা নিয়ে আমরা কাজ করছি
এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম পারভেজ তমাল: লক্ষ্মীপুর- ২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলকাণ্ডেও ব্যাংকটি বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। অর্থ ও মানবপাচারের অপরাধে কুয়েতের আদালতে সাজা পাওয়ায় এমপি পদ বাতিল হয় পাপুলের। তিনি ব্যাংকটির পরিচালক ছিলেন।  কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংকটি আট হাজার ৬৪৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২২৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। যা ডিসেম্বরে ছিল ১৪০ কোটি ১০ লাখ টাকা। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের কারণে বিপুল অঙ্কের অর্থ প্রভিশন হিসাবে রাখতে হয়েছে। ফলে নিট মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। 

এ বিষয়ে এনআরবিসি ব্যাংকের  চেয়ারম্যান এস এম পারভেজ তমাল বলেন, ৫৩ জন প্রবাসী একটি স্বপ্ন নিয়ে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের স্বপ্ন সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। যেসব মানুষ ব্যাংকিং সেবা থেকে বঞ্চিত, যারা নিজেদের কর্মের জন্য কারও সহযোগিতা পাচ্ছেন না, তাদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় এনে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। সেই লক্ষ্যে উপশাখা ব্যাংকিং ধারণা নিয়ে আমরা কাজ করছি। 

‘আমরাই সবচেয়ে বেশি উপশাখা স্থাপন করেছি। যেসব এলাকায় ব্যাংকের শাখা নেই আমরা সেই এলাকার মানুষদের জন্য কাজ করছি। আমাদের লক্ষ্য দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে মানুষের আয় বাড়ানো এবং তাদের স্বাবলম্বী করা। এজন্য পার্টনারশিপ ব্যাংকিং চালু করেছি। প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষও এর আওতায় ৯ শতাংশ বা তার চেয়ে কম সুদে ঋণ পাবেন। পাশাপাশি আমরা সরকারের সঙ্গে নানা সেবামূলক কাজে যুক্ত’— বলেন এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান। 

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom